গুরু মহাশয়
.jpg)
পল্লীকবি জসিমউদদীন ও তাঁর 'কবর' কবিতা নিয়ে আলোচনা
মোঃ আরিফ হোসেন
পল্লীকবি জসিমউদ্দীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ। তাঁর কবিতায় গ্রাম বাংলার চালচিত্র অনন্যভাবে ফুটে ুউঠেছে।জসিমউদদীন সবসময় চেয়েছিলেন তাঁর কবিতায় যেন গ্রামবাংলার আবহচিত্র এক অনরূপ ধারন করে ভেসে ওঠে।
জসিমউদ্দিন বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে ১৯০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন।জসিমউদদীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে পড়ালেখা করেন।এখান থেকে তিনি তাঁর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং এমএ পাস করেন।
জসিমউদদীন সবসময় গ্রামবাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন তাঁর কাব্যে।তিনি তাঁর ' আসমানী ' কবিতায় বলেছেন, ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে, সেই জলেতে রানা-খাওয়া আসমানীদের চলে।এখানে কবি গ্রামের মানুষের দুঃখের ছবি অত্যন্ত নিবিড় ভাবে আঁকতে চেয়েছিলেন।
নিম্নে জসিমউদদীনের 'কবর' কবিতার আলোচনা উপস্থাপন করা হল।
পল্লীকবি জসিমউদদীনের কবর কবিতাটি নিম্নরূপ:
কবর
জসিমউদ্দীন
এইখানে তোর দাদিরর কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল লইয়া ক্ষেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি করিয়া জানিনা কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট- খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।
বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।
শাপলার হাটে তরমুজ বেচি দু'পয়সা করে দেড়ী
পুৃঁতির মালার এক ছড়া নিতে কখনও হতনা দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধ্যাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!
হেস না- হেস না- শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদু যে তোমার কত খুশি হইত দেখিতিস যদি চেয়ে!
নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখি জলে।
আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়!
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়,
আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।
তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি,
যেখানে যাহারা জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের শত কবরের অংক হৃদয়ে আঁকি
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনা মুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে লাগায়ে বুক,
আয় -আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।
এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,
কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানেনা।
সেই ফালগুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি
বা-জান, আমার শরীর আজিকে কি যে করে থাকি থাকি।
ঘরের মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও,
সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কী জানিত কেউ?
গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,
তুমি যে কহিলা বা-জানেরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?
তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!
তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জড়ায়ে ধরি,
তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিত সারা দিনমান ভরি।
গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেত ঝরে
ফালুগুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।
পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ
চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।
আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।
উদাসিনী সেই পল্লী
-বালার নয়নের জল বুঝি,
কবর দেশের আঁধার ঘরে পথ পেয়েছিল খুঁজি।
তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ,
হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ।
মরিবার কালে তোরে কাছে ডাকি কহিল, বাছারে যাই,
বড় ব্যথা র'ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে,
কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।
ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গন্ড ভিজায়ে নয়ন জলে,
কি জানি আশিষ করে গেলে তোরে মরণ- ব্যথার ছলে।
ক্ষণপরে মোরে ডাকিয়া কহিল- আমার কবর গায়
স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।
সেই সে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,
পরাণের ব্যথা মরেনাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষনে ক্ষণে।
জোড়-মাণিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু-ছায়,
গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়।
জোনাকী-মেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,
ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন ভেসে ভাল।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, রহমান খোদা! আয়;
ভেস্ত নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়।
এইখানে তোর বু-জীর কবর, পরীর মতন মেয়ে,
বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের ঘরে বনিয়াদি ঘর পেয়ে।
এত আদরের বুজিরে তাহারা ভলবাসিতনা মোটে,
হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।
খবরের পর খবর পাঠাত, দাদু যেন কাল এসে,
দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।
শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কী চাহিয়া দিতে
অনেক কহিয়া আনিলাম তাহারে সেবার এক শীতে।
সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটেনা সেথায় হাসি।
কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি।
বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন
কে জানিত হায় তাহারও পরাণে বাজিবে মরণ-বীণ!
কী জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিলনা ফিরে
এইখানে তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু!ধীরে।
ব্যথাতুর সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো
কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।
বনের ঘুঘুরা উঁহু উঁহু করি কেঁদে মরে রাতদিন
পাতায় পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়,
আমার বু-জীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।
হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুফু, সাত বছরের মেয়ে,
রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।
ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা,
অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা!
ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে
তোমার দাদুর ছবিখানি মোর হৃদয়ে উঠিত ছেয়ে।
বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা
রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।
একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,
ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতীমা লুটায় পথের পরে।
সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে
কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।
আপন হস্তে সোনার প্রতীমা কবরে দিলাম গাড়ি।
দাদু! ধর-ধর- বুক ফেটে যায় আর বুঝি নাহি ফিরি।
এইখানে এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু,
কথা কস নাকো, জাগিয়া উঠিবে ঘুম-ভোলা মোর যাদু।
আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে
দীন দুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে!
ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূর।
হাতজোড় দাদু মোনাজাত কর আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত প্রাণ।
পল্লীকবি জসিমউদ্দীন এই কবিতায় মানুষের জীবনের মৃত্যু নিয়ে যে দুঃখবোধ তার একটি স্বরূপ সহজ বাংলা ভাষায় আঁকতে চেয়েছেন। কবি, মানুষ পৃথিবীতে আসে এবং এখানে তার আত্মীয় স্বজন পরিজনের মায়ায় জড়িয়ে যায় কিন্তু এক সময় সবাই তাকে ছেড়ে পরপারে চলে যায় এবং নিজেও একদিন চলে যায় সে কথা বলতে চেয়েছেন। কবি বলতে চেয়েছেন, পৃথিবীতে মানুষের আসা এবং যাওয়া দুঃখের। কবি বলতে চেয়েছেন মানুষ এক সময় পৃথিবীতে আসে, আনন্দ করে, এক সময় চলে যায় দুঃখ নিয়ে, সে এখানে থাকতে চায় কিন্তু থাকতে পারিনা।
যাইহোক কবির এ কবিতাটি একটি অনবদ্য কবিতা। এ কবিতা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা। এ কবিতা যখন লেখা হয় অর্থাৎ প্রকাশের সাথে সাথেই জনপ্রিয়তা পায়।কবিতাটি আমাদের এক গভীর মর্মবোধে নিয়ে যায়, কবিতাটির আবেদন ফেলনা নয়, কবিতাটি পড়লেই এক দুঃখবোধ জেগে ওঠে।কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে অমিয় সম্পদ হিসেবে বেঁচে থাক এই কামনা।
আপনার মন্তব্য আমার অনুপ্রেরণা
ReplyDelete